শবে মিরাজ: মানবজাতির কল্যাণময় উপহারপ্রাপ্তির রাত - Shob E Meraz

মিরাজ মহানবী (সা.)-কে আল্লাহর দেওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিজা বা অলৌকিক কীর্তি। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া অন্য কোনো নবী বা রাসুল এই সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি। এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে কাছে ডেকে নিয়ে মুসলমানদের ওপর ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাত ফরজ করে দেন। (মিশকাত; বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা, পৃষ্ঠা: ১১৬-১২৫) 

শবে মিরাজ, যার আরবি হলো ‘লাইলাতুল মিরাজ’। মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্বারোহণ। শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ অর্থ হলো ঊর্ধ্বগমনের রজনী। মিরাজের প্রথম অংশ তথা মক্কার বাইতুল্লাহ থেকে জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ হলো ইসরা। মসজিদুল আকসা থেকে আসমান পর্যন্ত সফর হলো মিরাজ। ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। যেহেতু নবীজি (সা.)–এর মিরাজ রাত্রিকালেই হয়েছিল, তাই এটিকে ইসরা বা লাইলাতুল ইসরা বলা হয়। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ৭৬৩-৭৭৯) 

রাসুল (সা.) যে রাতে আল্লাহ তাআলার ডাকে সাড়া দিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেছিলেন, সেই রাত ও সেই পবিত্র অভিযাত্রাকে শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ বলা হয়। মিরাজের প্রেক্ষাপট হলো: এ বছর নবীজি (সা.)–এর চাচা আবু তালেব ও তার তিন দিন পর নবীজির সহধর্মিণী হজরত খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন। এ বছরকে নবীজি (সা.)–এর জীবনে ‘আমুল হুজন’ বা দুঃখের বছর বলা হয়। রাসুল (সা.)-এর দুঃখ নিবারণ, সান্ত্বনা দেওয়ার নিমিত্তে আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বান্দাকে কাছে ডেকে সম্মানিত করেন। (সিরাতুন নবী (সা.), ইবনে হিশাম, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা: ৭১-৮৯) 

প্রিয় নবী (সা.)–এর নবুয়তের একাদশ বছরে, হিজরতের তিন বছর আগে (৬২০ খ্রিষ্টাব্দে) ২৭ রজবের রাতে মিরাজ সংঘটিত হয়। তখন নবীজি (সা.)–এর বয়স ছিল ৫১ বছর। এক রাতে মহানবী (সা.) তাঁর সহধর্মিণী উম্মে হানি (রা.)–এর ঘরে নিদ্রিত ছিলেন। সেখান থেকে বোরাক নামের বিশেষ বাহনের মাধ্যমে তিনি কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদে আকসায় গমন করেন এবং সেখানে তিনি সব নবীর ইমাম হয়ে জামাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। এ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে প্রিয় নবী (সা.) হয়ে ওঠেন ইমামুল মুরসালিনা ওয়ান নাবিয়্যিন। এরপর বোরাক বাহনে আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন।



মিরাজের সফরে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে বিভিন্ন নবী-রাসুলের সাক্ষাৎ হয়। প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহিয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.), সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)–এর সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় হয়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ২৩২-২৫৩)। 

নবীজি (সা.) কাবাঘরের ঠিক ওপরে সপ্তম আসমানে অবস্থিত ফেরেশতাদের কিবলা বাইতুল মামুর মসজিদে গেলেন। এখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা তাওয়াফ করেন। যাঁরা এক দিন তাওয়াফ করেছেন, তাঁদের আর কিয়ামত পর্যন্ত তাওয়াফ করার সুযোগ থাকে না। অতঃপর ‘সিদরাতুল মুনতাহা’র কাছে যান। সেখান থেকে নবীজি (সা.) একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিমে পৌঁছান। এখানে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং প্রভুর সঙ্গে একান্ত আলাপে মিলিত হন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তিনি নিকটে এসেছেন এবং অতীব নিকটবর্তী হয়েছেন। এমনকি দুই ধনুকের মতো নিকটবর্তী হয়েছেন, এমনকি আরও অধিকতর নিকটবর্তী হয়েছেন।’ ‘তিনি যা দেখেছেন, অন্তর তাকে অস্বীকার করেনি।’ ‘তাঁর দৃষ্টি বক্র হয়নি এবং লক্ষ্যচ্যুত হয়নি।’ (সুরা-৫৩ নাজম, আয়াত: ৮-১৭) 

আল্লাহ তাআলার দিদার লাভ ও সরাসরি কথোপকথন শেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়। তাই নামাজকে বলা হয় মুমিনের মিরাজ। অতঃপর জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। মিরাজের ঘটনা দিয়ে শুরু হওয়ায় সুরা বনি ইসরাইলের আরেক নাম হলো সুরা ইসরা। বুখারি শরিফ, মুসলিমসহ সিহাহ সিত্তাহ ও অন্য হাদিস গ্রন্থে এই ইসরা ও মিরাজের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ১৩০২-১৩০৬)

সুরা বনি ইসরাইলে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মসজিদুল হারাম থেকে আল মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা-১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত: ১) 

শবে মিরাজের উপহার সম্পর্কে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, মিরাজের রাতে নবী করিম (সা.) ও তাঁর উম্মতের জন্য কয়েকটি জিনিস দান করা হয়। প্রথমত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; দ্বিতীয়ত, তাঁর উম্মতের মধ্যে যেসব ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কারও শরিক করবে না, তাদের জন্য ক্ষমা। তৃতীয়ত, সুরা বাকারার শেষ অংশ। চতুর্থত, সুরা বনি ইসরাইলের ১৪ দফা নির্দেশ। (সুরা-১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত: ২২-৪৪)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url