অতিরিক্ত চিন্তা এবং দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় জেনে নিন


একদিন এক শিষ্য গুরুর কাছে এসে বললেন গুরু আমার মন বড়ই অশান্ত। রাগ, ক্ষোভ, দুশ্চিন্তা আর হিংসাতে আমার মন ভরে গেছে। আমি এর থেকে মুক্তি চাই। আমি সুন্দর হাসি-খুশি জীবন যাপন করতে চাই। গুরু খানিক চিন্তা করে তার হাতে থাকা গ্লাসটি দিয়ে শিষ্যকে বললো যাও ঐ দীঘি থেকে আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। লোকটি গ্লাস নিয়ে পানির জন্য গিয়ে দেখলো দীঘির সব জলই ঘোলা হয়ে আছে। লোকটি ফিরে এলো। গুরুকে বললো দীঘির সব জলইতো ঘোলা হয়ে আছে। গুরু বললেন, তুমি যদি তোমার অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি চাও, তোমার মনের সব খারাপ চিন্তা থেকে বাঁচতে চাও, তোমার সব নেগেটিভ চিন্তা দূর করার উপায় খুঁজতে চাও তাহলে ঐ দীঘি থেকে তোমাকে পরিষ্কার একগ্লাস পানি নিয়ে আসতেই হবে। লোকটি আবারও গেল কিন্তু পানিতো পরিষ্কার নয়। তাই লোকটি পানি না নিয়েই ফিরে এলো। খালি গ্লাস দিয়ে গুরুকে বললো গুরু পানিতো এখনো ঘোলা। কি করবো? 

গুরুজি হুংকার দিয়ে বললো তোমার দুশ্চিন্তার ঔষধ ঐ দীঘির পরিষ্কার পানি নিয়ে এসো। মনে মনে রাগ হলেও লোকটি পুনরায় গেল পানি নিয়ে আসতে। খালি গ্লাস নিয়ে ভাবতে ভাবতে লোকটি ফিরে এলো। গুরু শেষবারের মতো বললো দুশ্চিন্তা দূর করতে হলে তোমাকে পানি নিয়ে আসতে হবে। লোকটি কিছু দূর যাবার পর গুরুজি বললো আর হ্যাঁ শোন। এবারও যদি পানি ঘোলা হয়ে আছে তাহলে দীঘির মধ্যে না নেমে অপেক্ষা করবে। দীঘিতে নামার দরকার নেই। একটা সময় পর ঠিকই পানি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখন গ্লাসে করে পানি নিয়ে এসো। লোকটি পুনরায় গ্লাস নিয়ে গেলো এবারে পানি কিছুটা পরিষ্কার আরও পরিষ্কারের জন্য লোকটি চুপচাপ দীঘির পাড়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। এভাবে আস্তে আস্তে কিছু সময় পর দিঘীর পানি পুরো পারিষ্কার হয়ে গেল। তারপর লোকটি এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলো।

গুরুজী লোকটির হাত থেকে পাানি নিয়ে ছোট্র করে একটা মুচকি হাসি দিলেন। ততক্ষনে লোকটি তার উত্তর পোয়ে গেছে। লোকটি বললো বার বার অকারনে ঐ দীঘির পাড়ে গিয়ে ফিরে আসায় আমি বেশ বিরক্ত হচ্ছিলাম। কিন্তু এখন আমি আপনার বার্তাটা বুঝতে পারছি। এটাই আমার জন্য বুঝতে পারা সবচেয়ে বেশি গরুত্বপূর্ন। আমি বুঝতে পারছি দীঘিতে ঝাপিয়ে পড়লে দীঘির পানি যেমন আরও বেশি ঘোলাটে হয়ে উঠতো ঠিক একই ভাবে আমি যদি আমি আমার মনের ভিতর যা চলছে সেগুলোকে থামাতে ঝাপিয়ে পড়ি তাহলে সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে। তাই সমস্যার ভিতরে ঝাপিয়ে না পড়ে পাশে বসে সেগুলোকে দেখতে থাকাটাই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান।

আমাদের মনে যখন ভয়, রাগ, দুশ্চিন্তা, হিংসা, ক্ষোভ, কষ্ট এগুলো দেখা দিবে তখন আমি আমরা মন থেকে নিজেকে দূরে রেখে শান্তভাবে এগুলো দেখবো এবং অপেক্ষা করবো যতক্ষন না এগুলো দীঘির জলের কাঁদার মতো আপনা থেকেই থিতিয়ে পড়ে আবার পরিষ্কার না হয়ে উঠছে। তো যখন আপনার মন নেগেটিভ অনুভূতিতে ভরে উঠছে তখন সেটার সাথে লড়াই না করে বরং মনটাকে একটু শান্ত থাকার সময় দিন। দেখবেন নিজে থেকেই সেটা পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

দূর্ভাগ্যবশত মন খারাপ হলে আমরা ঠিক উল্টোটা করার চেষ্টা করি। এটা সেটা করে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। এটাই আমাদের যাবতীয় সমস্যা, মনের ভিতর বেড়ে উঠা দুশ্চিন্তাগুলোকে আরও বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। একটা কথা চিন্তা করুন বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ধরুন আপনার কোনভাবে আপনার হাত কেঁটে গেছে এবার আপনি কাটা হাত নিয়ে যদি খোঁচাখুচি করেন তাহলে আপনার কাঁটা জায়গায় ক্ষত সেরে উঠবে না বরং বেড়ে উঠবে।

যখনি আমাদের মাথায় কোন নেগেটিভ চিন্তা আসবে তার উপর ঝাপিয়ে না পড়ে চুপচাপ দূরে থেকে দর্শকের মত অবজার্ভ করা। বোঝা গেলোনা ব্যপারটা? তাহলে একটা উদাহরণ খেয়াল করুন। ধরুন আপনি গাড়ি করে যাচ্ছেন রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে ফেঁসে গেলেন তখন একটা অনুভুতি। ট্রাফিক জ্যামটা দেখতে তখন একরকম লাগবে। এবার ধরুন আপনি একটা প্যারাসুটে করে যাচ্ছেন আর নিচে তাকিয়ে দেখলেন সবাই ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে তখন কিন্তু সেটা কিছুটা আনন্দের অনুভুতি হবে। তাই আপনাকে দূরে থেকে আপনার মনের ট্রাফিক জ্যামটা ফলো দেখতে হবে তাহলে কিছুটা হলেও আনন্দ লাগবে। কিন্তু যদি আপনি আপনার মনের ট্রাফিক জ্যামটা দেখে তা সারানোর জন্য উঠে পড়ে লেগে যান তাহলে আপনার মন চঞ্চল আর অশান্ত হয়ে উঠবে। একটা জ্যাম সারাতে গিয়ে আরেকটা জ্যাম বাঁধবে (এটাইতো হয় আমাদের রাস্তাঘাটে) । একটা নেগেটিভ চিন্তা সারাতে হাজার নেগেটিভ চিন্তা ধরা দিবে।

একটু খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের মন সবসময় কিছু না কিছু সংগ্রহ করার চেষ্টা করে। কিভাবে পরীক্ষায় এ+ পাবো, কিভাবে ধনী হওয়া যায়, কিভাবে সুন্দর একটা মেয়ের সাথে প্রেম করতে পারবো, কিভাবে ডাক্তার হবো, কিভাবে ঘুরতে যাওয়া যায়, কিভাবে সেলিব্রেটি হবো? কিভাবে আরো পাবো আরো পাবো। এটা আমাদের একটা কমন সমস্যা। এটাই মূলত আমাদের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার মূলে রয়েছে?

এ সমস্যার সমাধান কি? এর সমাধান একটাই আপনার মনে যখনই কোন চিন্তা আসবে আপনি তা দূর থেকে দেখবেন। মনে যাই আসুক না কেন আপনি শুধু তা দেখছেন একজন দর্শকের মত। নিজেকে শান্ত রাখতে পারলে দুশ্চিন্তাগুলো অটোমেটিক শান্ত হয়ে হারিয়ে যাবে। অতিরিক্ত চিন্তা দূর করার জন্য, খারাপ চিন্তা থেকে বাঁচার জন্য, নেগেটিভ চিন্তা দূর করার জন্য আপনার মনে আসা যেকোন চিন্তার ভালোমন্দ দিক বুঝে নিতে হবে। তারপর তাতে সায় দিতে হবে।

অনেকে মনে করেন আর চিন্তাই করবোনা। এ বলে কি মনকে আটকাতে পাারবেন। দুশ্চিন্তা, খারাপ চিন্তা কিংবা বাজে চিন্তাকে আটকাতে আপনি আরও কিছু দৈনিক নিয়ম ফলো করতে পাারেন। তো চলুন নিয়মগুলো দেখে নেই:

১। নিয়মিত ব্যয়াম করতে হবে

অনেকের মাথায় ব্যয়ামের কথা আসলেই বলে কাল থেকে শুরু করবো। আবার মেয়েদের অনেকেই মনে করছেন ব্যয়ামের দরকারই নেই। একদল পুরুষ কাল থেকে ব্যয়াম শুরু করেনা আবার আরেকদলে কিছুৃ মেয়েরা কোন দিনই ব্যয়াম করেনা। আবার কেউ আছেন যেদিন ব্যয়াম শুরু করছেন ঐদিনই চেষ্টা করেন সারা মাসের ব্যয়াম শেষ করে নিতে। এসব চিন্তাই ক্ষতিকর। ব্যয়াম সবার নিয়মিত করতে হবে। সকালটায় যদি রুটিন অনুযায়ী ব্যয়াম করেন তাহলে দেখবেন সারাদিন এমনিতেই ফুরফুরে লাগছে। তারজন্য জিম বাধ্যতামূলক নয়। বাসার ছাদে কিংবা রাস্তায় জগিং করতে পারেন, লিফট ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করতে পারেন। অল্পটাকা খরচ করেই জিম করার জন্য ব্যাসিক যন্ত্রপাতি কিনে নিতে পারেন। শেষকথা, হচ্ছে জিম হোক আর না হোক নিয়মিত ব্যয়াম করবেন। সকালটা সুন্দর শুরু হলে দুশ্চিন্তা আর আপনার কাছে আসতে পারবেনা।

২। সময়মতো পরিমিত খাবার খাবেন

নগর জীবনে আমরা খাবার অভ্যাসটাই পরিবর্তন করে ফেলেছি। অনেকে সকালের নাস্তা করেন বেলা দশটায় একটায় নাস্তা করেন আর চারটায় দুপরের খাবার খান। রাতের খাবার বারোটায়। খাবারের এ নিয়মটাকে অনেকে ফ্যশন মনে করেন। এটা আমাদের অজান্তেই আমাদের ক্ষতি করছে। তাই নিয়মিত খাবার খাবেন এবং অতিরিক্ত নয় পরিমিত খাবেন।

৩। সময় মতো পানি পানের অভ্যাস করতে হবে

পানি আমাদের শরীরের জন্য অত্যান্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। সাধারণত আমরা অতিরিক্ত তৃষ্ণা না পেলে পানি পান করিনা। যা মোটেই উচিৎ নয়। নিয়মতি বিরতিতে পাানি পান করবেন। পানি পানের সঠিক নিয়ম মানতে হবে। এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন এটা এমনি এমনি বলা হয়না। শরীর সুস্থ্য থাকলে বাজে চিন্তা ভাবনা এমনিতেই কম আসবে আপনার মাথায়।

৪। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করুন

আমাদের একটা স্বভাব হলো আমরা কোন রকম দায়িত্ব নিতেই চাইনা। এটা আপনার ব্যক্তিত্বকে খাটো করে। সামর্থ অনুযায়ী দায়িত্ব নিন। হাতে কাজের প্রেশার থাকলে খারাপ চিন্তা আসার রাস্তাই পাবেনা। অটোমেটিক খারাপ চিন্তা থেকে দূরে থাকবেন।

৫। প্রতিদিনের লক্ষ্য ঠিক করুন

প্রতিদিন-ই সকাল সকাল লক্ষ্য স্থির করুন। আপনার ঠিক করা লক্ষ্যে নিশ্চই দুশ্চিন্তা করার জন্য সময় রাখবেন না। তাই লক্ষ অনুযায়ী কাজ করলে অতিরিক্ত চিন্তা করার সময় পাবেন না। আর দিনের লক্ষ্য পূরন হলে একধরনের প্রশান্তি বোধ করবেন। যা আপনাকে অনেক বেশি আনন্দিত এবং ভালো রাখতে সাহায্য করবে।

৬। সময়মতো ঘুমাতে যান এবং সময়মত ঘুম থেকে উঠুন

অনেকেই আছেন ভোর রাতে ঘুমাতে যান আর দিনের একটায় ঘুম থেকে উঠেন। ছোট বেলার ইংরেজী কবিতা Early to Bed এর কথা একদম ভুলেই গেলেন। সকাল সকাল ঘুমাতে যাওয়া এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা শুধু আপানর স্বাস্থ্যই ভালো রাখবেনা আপনাকে জ্ঞানীও করে তুলবে। তাই নিয়ম করে সকাল সকাল ঘুমাতে যান এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠুন। মন ভালো থাকবে, কাজে নিজেকে চাঙ্গা লাগবে।

৭। ভালোলাগার কাজ বেশি বেশি করুন

ভালো লাগার কাজ বেশি বেশি করুন। তার মানে এই নয় যে সারাদিন মোবাইলে কিংবা পিসিতে গেমস খেলবেন। আপনি চাইলে ফুলের বাগান কিংবা ফলের বাগান করতে পারেন, পশু পাাখি পুষতে পারেন, ভালো বই পড়তে পারেন, ট্রাভেলিং করতে পারেন। এগুলি আপানার মনতে প্রশান্ত রাখবে। মনে বাজে চিন্তা কিংবা নেগেটিভ চিন্তা আসতে দিবেনা।

আশা করছি এ বিষয়গুলো দুশ্চিন্তার ঔষদ হিসাবে কাজ করবে। নেগেটিভ চিন্তা, দুশ্চিন্তা কিংবা খারাপ চিন্তা দূর করার জন্য এগুলি করে দেখতে পারেন। ভালো লাগবে । আপনাদের ভালো লাগাই আমাদের কাম্য। আমাদের সাথেই থাকবেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url