যে কারনে উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপান যাবেন
জাপান হলো পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এই দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জাপান সাগর, পূর্ব চীন সাগর, চীন, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও রাশিয়ার পূর্ব দিকে উত্তরে ওখোৎস্ক সাগর থেকে দক্ষিণ পূর্ব চীন সাগর ও তাইওয়ান পর্যন্ত প্রসারিত। জাপানকে “উদীয়মান সূর্যের দেশ” বলে অভিহিত করা হয়। টোকিও জাপানের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি টোকিওতে প্রায় ৯০ লাখ লোকের বাস। টোকিও ছাড়াও অন্যান্য শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে ইযুমো, ইয়োকোহামা, সাপ্পোরো প্রভৃতি। ব্যতিক্রমধর্মী ও উন্নত প্রযুক্তির ক্রমাগত উদ্ভাবনের ফলে জাপান নিজেদের অর্থনৈতিক খাতকে করে তুলেছে সমৃদ্ধ। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবদিক থেকেই দেশটি বিখ্যাত।
জাপানের শিক্ষার মানও অত্যন্ত উন্নত এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বর্তমানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের কাছে জাপানের নাম তালিকার শীর্ষের দিকেই থাকে। সূর্যোদয়ের এ দেশটিতে বর্তমানে বহু বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পরিমাণ কম নয়।
দেশটির উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ, জাপানের বন্ধুভাবাপন্ন সংস্কৃতি আর আবহাওয়ার কথা, বিবেচনা করলে জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আপনার আগ্রহ বাড়বেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫ লাখ ছাত্রছাত্রী বিদেশে পড়াশোনা করছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৫ জন ছাত্রছাত্রী জাপানে পড়াশোনা করছে। অর্থাৎ বৈদেশিক ছাত্রছাত্রীদের প্রায় ৯.৫ শতাংশই জাপানে অধ্যয়নরত।
এখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের এ ব্যাপক চাহিদার কারণ হচ্ছে জাপানে ছাত্রছাত্রীরা যুগোপযোগী সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এবং জ্ঞান অর্জন করতে পারে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নতির মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে মেডিসিন, সাহিত্য থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রশাসন যে কোনো বিষয়েই জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার বিস্তৃত সুযোগ রয়েছে।
জাপানে পাঁচ ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়, আন্ডার গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ অব টেকনোলজি, জাপানিজ স্টাডিজ, প্রফেশনাল ট্রেনিং স্কুল। আন্ডার গ্রাজুয়েট পর্যায়ে বেশিরভাগ কোর্সের মেয়াদ ৪ বছর। তবে মেডিসিন, ডেন্টিস্ট্রি ও ভেটেরিনারি সায়েন্সের ক্ষেত্রে এর মেয়াদ ৬ বছর। পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সের মেয়াদ ২ বছর। ডক্টরেট ডিগ্রির কোর্সের মেয়াদ ৩ বছর। তবে মেডিসিন, ডেন্টিস্ট্রি ও ভেটেরিনারি সায়েন্সের ক্ষেত্রে এর মেয়াদ ৪ বছর হয়ে থাকে।
১। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা: ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইউনিভার্সিটিজ, বিশ্বের শীর্ষ পাঁচশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় জাপানের রয়েছে ২০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব টোকিও রয়েছে ২১তম স্থানে ও কিয়োটো ইউনিভার্সিটি ২৬তম স্থানে। এছাড়া দেশটির ওসাকা ইউনিভার্সিটির অবস্থান বিশ্বে ৭৮তম।
বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তালিকার ভিত্তিতে বলা যায়, গুণগত এবং বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদান করে জাপানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বে জায়গা করে নিতে পেরেছে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা দেশটিতে উচ্চশিক্ষা নিতে আসছে। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এশিয়ায় চীনের পর জাপানেই সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে আসে।
বেশিরভাগ জাপানি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাপানি ভাষায় পাঠদান করা হয়। কাজেই জাপানে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চাইলে অবশ্যই একজন শিক্ষার্থীকে জাপানি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। জাপানি ভাষা শেখার জন্য বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা ঢাকার জাপান অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বিভিন্ন মেয়াদের জাপানি ভাষা শিক্ষা কোর্স রয়েছে। জাপানি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য বিষয়ে পাঠদান করা হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে,
হিউম্যান স্টাডিজ, হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজ, হিউম্যান সায়েন্স, এডুকেশনাল সায়েন্স, ল অ্যান্ড সোসাইটি, পাবলিক ল অ্যান্ড পলিসি, ইকোনমিক্স, ম্যানেজমেন্ট, অ্যাকাউন্ট্যান্সি, ফিজিক্স, অ্যাস্ট্রোনমি, জিওফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, আর্থ সায়েন্স, মেডিকেল সায়েন্স, ডিজঅ্যাবিলিটি সায়েন্স, ডেন্টিস্ট্রি, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, বায়োফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স, লাইফ সায়েন্স, মেকানিক্যাল সিস্টেমস অ্যান্ড ডিজাইন,ন্যানোমেকানিক্স, অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য আপনি জাপান যেতে পারেন।
জাপান বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি। তাই জাপান জুড়ে তারা অসংখ্য প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে। জাপানের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলো- ইউনিভার্সিটি অব টোকিও, কিয়োটো ইউনিভার্সিটি, ওসাকা ইউনিভার্সিটি, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, তোহুকু ইউনিভার্সিটি, কেইও ইউনিভার্সিটি, কিয়ুশু ইউনিভার্সিটি, নাগোয়া ইউনিভার্সিটি।
২। বৃত্তির সুবিধা: আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য জাপানে বিভিন্ন বৃত্তি ও টিউশন ছাড়ের সুবিধা আছে। এ সুবিধার আওতায় সম্পূর্ণ বিনা খরচেই একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন। সরকারি বৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বৃত্তি দিয়ে থাকে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। একজন শিক্ষার্থী এসব বৃত্তিতে নির্বাচিত হয়ে জাপানে পড়ালেখার জন্য যেতে পারেন। আবার সেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও আবেদন করা যায় বৃত্তির জন্যে।
৩। কাজের সুযোগ: পড়ালেখা চলাকালীন সপ্তাহে ২৮ ঘণ্টা খণ্ডকালীন কাজ করার সুযোগ রয়েছে জাপানে, যা ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশেও নেই। ছুটির সময় বেশি কাজ করতেও কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কাজের সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি আয়ের পরিমাণও আকর্ষণীয়। প্রথম অবস্থায় জাপানে প্রতি ঘণ্টায় পার্টটাইম কাজের বেতন সর্বনিম্ন ১০০০ থেকে ১২০০ জাপানি ইয়েন। দক্ষতা বাড়ার সাথে সাথে বেতনও বাড়তে থাকে।
৪। স্থায়ী বসবাসের সুযোগ: জাপান সরকার দেশটিতে বিদেশী নাগরিকদের স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদনের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, পর্যাপ্ত পয়েন্ট অর্জন করতে পারলে যে কেউ মাত্র এক বছরেই দেশটিতে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাবেন। নতুন নিয়ম জলদি কার্যকর করা হবে জাপানের অভিবাসন ব্যুরো জানিয়েছে।
জাপান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশী দক্ষ পেশাজীবীদের জাপানে বসবাস উৎসাহিত করতে অভিবাসনের আগের নিয়ম সংস্কার করে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে স্থায়ী বসবাসের আবেদনের ক্ষেত্রে দেশটিতে ন্যূনতম ১০ বছর থাকতে হতো। জাপান সরকার ওই নিয়ম বদলে ‘পয়েন্ট সিস্টেম’ চালু করছে।
এতে ডক্টরেট পাওয়া বিদেশীদের জন্য ৩০ এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের জন্য ২০ পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়। শিক্ষক, গবেষক কিংবা অ্যাকাডেমি ক্ষেত্রে পেশাজীবীরা জাপানে ৩-৭ বছর কাজ করলে ৫ থেকে ১৫ পয়েন্ট পাবেন। জাপানি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ৩ থেকে ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে মিলবে ৫ থেকে ২০ পয়েন্ট। ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে একই সময়ের জন্য দেয়া হবে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ পয়েন্ট।
বার্ষিক আয় ও জাপানের কোনো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারী বিদেশীরা পেতে পারেন ১০ থেকে ৫০ পয়েন্ট। জাপানি প্রতিষ্ঠানে ভালো গবেষণাকর্মের স্বীকৃতি থাকলে সর্বোচ্চ ২৫ পয়েন্ট মিলবে। এ ছাড়া অন্তত ৪টি বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনকারী বিদেশীরা পাবেন ২০ বোনাস পয়েন্ট।জাপানি ভাষায় দক্ষতা থাকলে মিলবে আরও ১৫।
সব যোগ করে ৭০ পয়েন্ট হলে তিন বছর জাপানে বসবাস করছেন এমন বিদেশীরা স্থায়ী হওয়ার আবেদন করতে পারবেন, আর ৮০ পয়েন্টধারীদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ মিলবে এক বছরেই। নতুন এ নিয়মের ফলে বিদেশীরা সহজে দেশটিতে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৫। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: পৃথিবীর জনপ্রিয় ভ্রমণ স্থানগুলোর মধ্যে জাপান অন্যতম। ১৮টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজসহ সাগর আর পাহাড়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের জন্য স্বপ্নপুরী। এশিয়ার এই উন্নত দেশটি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলের অপূর্ব নিদর্শন। এখানে যেমন প্রাচীন ভবন ও মন্দির আছে তেমনি আধুনিক স্থাপত্য ও প্রকৌশল প্রযুক্তির অসামান্য সাফল্যও দেখতে পাওয়া যায়। সারা বছরই জাপানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তাছাড়া জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে কম অপরাধ প্রবণ দেশ। তাই পর্যটকদের জন্য জাপান আদর্শ স্থান।
গোল্ডেন প্যাভিলিয়ন, ফুজি পর্বতমালা, টোকিও ইম্পেরিয়াল প্যালেস, টোকিও টাওয়ার,হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল, তাছাড়া জিগোকুডানি মাংকি পার্ক, কিয়োমিজু ডেরা, হিমেজি ক্যাসেল, গ্রেট বুদ্ধা অফ কামাকুরা, টুডাইজি মন্দির, ঐতিহাসিক কায়োটো শহর, মন্দিরের শহর নারা, অসাকা ক্যাসেল, নাগুয়া শহরের আটসুটা মন্দির ইত্যাদি স্থানগুলো জাপানের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।
পর্যটন শিল্পেও জাপান অনেক এগিয়ে, পর্যটকদের প্রতি দেশটির বন্ধু সুলভ আচরণ দেশটি পর্যটন শিল্পকে উন্নত করে তুলেছে। মজার বিষয় হলো, জাপানে কোনো ডাস্টবিন নেই। জাপানিরা সব ধরনের বর্জ্য রিসাইকেল করার চেষ্টা করে। তবে যেগুলো সম্ভব নয়, সেগুলো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফেলা হয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে জাপানীরা অত্যন্ত সচেতন।