ত্রান বিতরন - ফেসবুকে ফ্যাশন নাকি ফোটো সুট? বিস্তারিত পড়ুন
ত্রান বিতরন |
বন্ধুটি বলল,‘ আরেহ আমার প্রেমিকা দেখবে তো ৷ প্রেমিকার চোখেই যদি বড় হতে না পারি তাহলে আর কার চোখে বড় হব! তাছাড়া আমার ফেসবুকে কত মেয়ে ফ্রেন্ড আছে ৷ আমার একটা পারসোনালিটি আছে, সেটাও তো তাদের দেখাতে হবে৷’
কথাটা শোনে আমি আর কিছু বললাম না ৷ মেসেঞ্জার থেকে বের হয়ে আবার ফেসবুকের টাইম লাইনে ঘুরতে লাগলাম ৷ চোখ আটকে গেল এক ছোট ভাইয়ের ছবিতে ৷
তারা দশ বারো জন ছেলে-পেলে মিলে ত্রাণ দিচ্ছে ৷ তাদের মধ্য স্থানে সে ব্যক্তি দাঁড়ানো— সে একজন নেতা৷ উনি , একজন করে অসহায় ব্যক্তিদের ত্রাণ দিচ্ছেন আর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মুচিক হাসি ৷ ছোট ভাইটি এই ছবির উপরে ক্যাপশনে
লিখেছেন—
‘ আমাদের প্রান প্রিয় (ডাব) ভাই অসহায়দের কল্যানে এগিয়ে এসেছেন ৷ এই যুদ্ধে তিনি সেনাপতি হয়ে কাজ করছেন ৷ আমরা গর্বিত তার সহযোদ্ধা হয়ে ৷ আমাদের (ডাব) ভাই এই সমাজের নক্ষত্র’
ছবিগুলো দেখা শেষে ছোট ভাইটিকে মেসেঞ্জারে নক দিলাম ৷ বললাম—‘ তোমাদের ত্রাণের ছবি দেখলাম ৷ ভালোই লাগলো ৷ তো কত জনকে ত্রাণ দিলে?’
ছোট ভাই বলল,‘সাত জনরে দিছি৷’
—‘কিন্তু ছবিতে তো প্রায় পঞ্চাশ জন দেখলাম৷’
—‘আমাদের নেতা ফোটগ্রাফার আনছিলো ৷ তাই ঐ সাতজনরেই বারবার ঘুরায়ে বিভিন্ন ভঙিতে ছবি তুলছে৷’
আমি আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না ৷ মেসেঞ্জার থেকে বেরিয়ে ফেসবুকের টাইম লাইন ঘাটতে লাগলাম৷
এক ধনী সহপাঠীর ছবিতে চোখ পড়লো ৷ প্রায় কয়েক শত অসহায় মানুষ লাইন ধরে বসে আছে ৷ সহপাঠী এবং তার বাবা, চাচা এক সাথে দাঁড়িয়ে ত্রাণ দিচ্ছে৷ তাদের পেছনে পোষ্টার টানানো ৷ সেখানে লেখা, খান পরিবার থেকে ত্রাণের আয়োজন ৷ খান পরিবার সমাজের অসহায় মানুষদের সাথে ছিল, আছে এবং থাকবে .......’
এটা দেখে সহপাঠীকে আমি আর মেসেজ দিলাম না৷ কারন সে কি বলতে পারে সেটা আমি বুঝতে পারছি৷
ত্রাণ জিনিসটা দুটা দিক চিন্তা করে দেয়া হয় ৷ প্রথমত, মানবতার দিকটি বিবেচনা করে ৷ দ্বিতীয়ত ধর্মীয় রীতি অনুসরন করে৷
কিন্তু অধিকাংশ ত্রাণ দাতাই কোন দিক চিন্তা না করে কেবল ত্রাণ দেয়ার উৎসবে মেতেছেন৷
যদি মানবতার দিক থেকে ত্রাণের ব্যাপারটা চিন্তা করি তবে সেখানে ত্রাণ দাতাদের মাথায় মানবিক ব্যাপারটা কতটুকু কাজ করে— সেটাতে বড় প্রশ্ন থাকে ৷ কারন, যারা ত্রাণ নিচ্ছে তাদের লজ্জা বোধ আছে ৷ ত্রাণ দাতাদের মত তারাও শারীরিক লজ্জা ঢাকে কাপড় দিয়ে ৷ যার শারীরিক দিক থেকে লজ্জা বোধ আছে, তার কি মনের দিক থেকে লজ্জা নাই? অবশ্যই লজ্জা বোধ আছে ৷
যারা পাগল তাদের শারীরিক লজ্জা থাকে না, মনের লজ্জাও থাকে না ৷ পাগলেরা বোঝে না লজ্জা বোধ জিনিসটা কি!
কিন্তু যারা ত্রাণ নিচ্ছে তারা পাগল না—গরিব, অসহায়, পরিস্থিতির শিকার ৷ ত্রাণ নিয়ে ক্যামেরার ফ্রেমে তাদের কেন মডেল হতে হবে? ত্রাণ দেয়েটা বড় জিনিস, গর্বের বিষয় ৷ কিন্তু ত্রাণ নেয়াটা গর্বের বিষয় না৷
ত্রাণ দাতা নিজের হাজারটা ছবি তুলুক ৷ খাবার হাতে সে— দাঁড়ায়ে, বসে, শুয়ে যেভাবে খুশি তুলুক ৷ কিন্তু সেই পরিস্থিতির শিকার মানুষদের ছবিতে টেনে আনাটা কি বীরের কাজ? মহাপুরুষদের কাজ?
আর ধর্মীয় রীতি অনুসারে ত্রাণ দেয়ার ছবি তোলা তো দূরের কথা, ডান হাতে দিলে বাম হাত যেন টের না পায় সে কথা বলা আছে৷
তবুও যেভাবেই হোক— অসহায়রা তো বাঁচার জন্য খাবার পাচ্ছে ৷
দেশের করোনা পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে সে হিসেবে এই ত্রাণের ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন নিয়ে যেতে হবে ৷ আশা রাখবো সামনে দিন গুলোয় অন্তত অসহায়রা ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে ত্রাণ নিতে পারবে ৷
খোদা না করুক— করোনা প্রকোপ যদি বছর জুড়ে থাকে তবে পরবর্তী ত্রাণ আপনাকে , আমাকেও নিতে হবে৷ তখন নিজে খেয়ে বেঁচে থাকার আশায় এই ত্রাণ বিতরণ নামক উৎসবে কেউ মাতবে না ৷
ত্রাণ কোন তুচ্ছের জিনিস না ৷ নিজেকে বড় করার বিষয় না ৷ এটা অসহায়দের অধিকার ...৷